বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চার সমন্বয়কের খোঁজ পেতে ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে তাদের সন্ধান না মিললে অফিস ও বাসাবাড়ির সামনে কালো কাপড় বেঁধে মৌন প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানানো হয়েছে। আগামীকাল বুধবার বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে অন্তত ১০ মিনিট দেশের সব অফিস ও বাসাবাড়ির সামনে এই কর্মসূচি পালন করা হবে।
গতকাল সোমবার রাতে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের সামনে সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সমন্বয়ক মাহিন সরকার ও হান্নান মাসুদ যৌথভাবে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
এদিকে সংগঠনের সমন্বয়ক সারজিস ইসলাম এবং সহসমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম সমকালকে জানিয়েছেন, তারা আজ মঙ্গলবার পৃথক কর্মসূচি দেবেন। কর্মসূচির প্রশ্নে দুই ধরনের বক্তব্য থেকে ছাত্রদের আন্দোলনে বিভক্তির আলামত স্পষ্ট হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে সমন্বয়ক মাহিন সরকার বলেন, ‘আমাদের চার সমন্বয়কসহ সমন্বয়কদের সঙ্গে কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারছি না দুই দিন ধরে। তারা হলেন সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবদুল কাদের, আবু বাকের মজুমদার ও সহসমন্বয়ক রশিদুল ইসলাম রিফাত। তারা সবাই সামনের সারিতে থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাদের টার্গেট করা হয়েছে। এখন আমাদেরও টার্গেট করা হচ্ছে। আমরা ভয়ভীতি প্রদর্শনের কারণে অন্য নেতাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারছি না। আমাদের ভাইবোনেরা কোথায় আছেন, সেটাও জানি না। এই চারজনের আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খোঁজ চাই।’
সমন্বয়ক হান্নান মাসুদ বলেন, ‘দুই দিনের আলটিমেটাম দিয়ে আন্দোলন স্থগিত করা হয়েছিল; কিন্তু তার পরও আজ (সোমবার) জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলি হয়েছে। আমাদের চারজন সমন্বয়ক-সহসমন্বয়কের বাবা-মা হাসপাতাল মর্গ ও থানায় থানায় খোঁজ নিচ্ছেন। ডিবি অফিসে গিয়ে খোঁজ পাচ্ছেন না। আমরা জাতির কাছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন রাখছি– একাত্তরে কি ত্রিশ লাখ মানুষ এরকম একটা রাষ্ট্রর জন্য শহীদ হয়েছেন?’
হান্নান বলেন, ‘আমরা তো একটা যৌক্তিক দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলাম। সেই যৌক্তিক দাবির জন্য কেন আমাদের ২০০ প্রাণ দিতে হবে। এ দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাছে, সরকার ব্যবস্থার কাছে, শাসন ব্যবস্থার কাছে, বিচার ব্যবস্থার কাছে ও সংবিধান মাথায় রেখে প্রশ্ন রাখতে চাই– একটি যৌক্তিক দাবি আদায়ে ২০০ প্রাণ দেওয়ার পর কেন সরকারের পক্ষ থেকে সংলাপের আহ্বান করা হবে? তার আগে কেন আহ্বান করা হয় নাই? কেন ছাত্রদের সঙ্গে বসে সমাধান করা হয় নাই? প্রতিটি ক্ষেত্রে কেন দমনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে একটা রাষ্ট্রকে? একটা স্বাধীন রাষ্ট্র কেন তারা দমন করবে? তার পর দমন করতে না পেরে দাবি মেনে নেবে?
উনারা ভুলে যাচ্ছেন ১৯৫২ সালে দমন করতে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ব্যর্থ হয়েছে, ৬৪, ৬৬, ৬৯ ব্যর্থ হয়েছে। উনারা কীভাবে সফল হবেন? আমরা এখনও বলব, আমাদের প্রতিটি ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। আমাদের ভাইদের ছেড়ে দিন।
কোটা আন্দোলনে বিভাজন?
প্রশ্ন উঠেছে, কোটা আন্দোলনকারীরা এক আছেন কিনা। একপক্ষ বলছে, দেশের প্রেক্ষাপটে বাস্তবায়নযোগ্য দাবিই তারা পেশ করেছে। অন্যপক্ষের দাবি, সরকার কয়েকজন আন্দোলনকারীকে জোর করে তাদের দাবি পরিবর্তন করিয়েছে।
সরকারের তিন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সাক্ষাৎকারী দলের অন্যতম সদস্য ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম সমকালকে বলেন, আলটিমেটাম শেষে আমরা আগামীকাল (আজ) সবার সঙ্গে বসব। সবাই আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব। কখন এবং কোথায় তারা কর্মসূচি জানাবেন– এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, এটা এখনই জানাতে চাচ্ছি না। কেননা আমাদের ফোন ট্যাপ করা হচ্ছে।
৮ ও ৯ দফার বিষয়ে তিনি বলেন, অনেকেই মনে করছেন যে, তারা আন্দোলন করে বিপ্লব আনবেন। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, কোটা সংস্কার করা এবং যারা আন্দোলনে মারা গেছেন, তাদের হত্যার বিচার নিশ্চিত করা। আমাদের উদ্দেশ্য গণঅভ্যুত্থান ঘটানো নয়। যেসব দাবি আদায় করতে পারব, আমরা সেগুলোই দিয়েছি। এটাকে যদি কেউ সমঝোতা বলেন, তাহলে আমি দায়িত্ব ছেড়ে দিতে প্রস্তুত আছি। তারা যেন সেসব দাবি আদায় করে নেন।
৫৯ জন সমন্বয়ক এবং সহসমন্বয়কের বিবৃতির বিষয়ে তিনি বলেন, আমরাও এই ৫৯ জনের নাম দেখতে চাই। আবদুল কাদেরের নামে বিবৃতি এসেছে। আমাদের তো ৬৫ জন সমন্বয়ক। ৬৫ জনের মধ্যে যে পাঁচজনের অন্য উদ্দেশ্য ছিল না, সেটা আমরা বলতে পারছি না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহসমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম সরকারের তিন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বসার বিষয়ে বলেন, আমরা সরকারের সঙ্গে সংলাপে বসিনি। কেননা, এত মানুষের লাশের ওপর দিয়ে আমরা সরকারের সঙ্গে বসতে পারি না। যেহেতু ইন্টারনেট বন্ধ, তাই আমরা আমাদের ৮ দফা দাবি সরকারের কাছে তুলে ধরতে তাদের সঙ্গে বসেছি, কোনো সংলাপে বসিনি। আমাদের এই ৮ দফা দাবি পূরণ সাপেক্ষে আমরা সরকারের সঙ্গে সংলাপে বসব কিনা– তা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। সরকারের মন্ত্রীদের মাধ্যমে দাবি তুলে ধরা আমাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত ছিল।
আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের মধ্যে কোনো ধরনের বিভাজন নেই। আমরা সবাই এক আছি। তাহলে তারা ৮ দফা, সমন্বয়কদের আরেকটি অংশ ৯ দফা কেন দিয়েছে– জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৮ দফা এবং ৯ দফার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। কিছুটা ভাষাগত পার্থক্য হয়েছে। এই দাবির বিষয়ে আমরা সবাই একমত।
৫৯ জন সমন্বয়কের বিবৃতির বিষয়ে তিনি বলেন, এটা হয়তো কেউ তাদের ব্যক্তিগত অভিমত সবার নামে চালিয়েছেন। এই বিবৃতিতে কোন ৫৯ জন রয়েছেন, তা উল্লেখ নেই। একটি নম্বর থেকে গণমাধ্যমে এই বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। এটি সমন্বিত বিবৃতি নয়।
অন্যদিকে, ৫৯ জন সমন্বয়কারীর পক্ষে বিবৃতি দেওয়া সমন্বয়ক আবদুল কাদেরের ফোন বন্ধ থাকায় তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে এই পক্ষের আরেক সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেন, ৫৯ জনের পক্ষ থেকে যে বিবৃতি পাঠানো হয়েছে, সেটাই আমাদের সবার বিবৃতি।
এ ছাড়া সোমবার সন্ধ্যায় সংগঠনের ৫৬ জন সমন্বয়ক বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তারা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিকে আরও জোরদার করার আহ্বান জানান। এ ছাড়া নাহিদ ইসলামকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতনের নিন্দা জানিয়ে তারা বলেন, এর সঙ্গে জড়িতদের বিচার করতে হবে। বিবৃতিতে তারা বলেন, আন্দোলনের প্রথম সারির কয়েকজন সমন্বয়ককে পুলিশি হেফাজতে নিয়ে মনগড়া বক্তব্য আদায়ের চেষ্টা করা হয়েছে। তারা আরও বলেন, শুধু আদালতের রায় দিয়ে সরকার দেশব্যাপী চালানো গণহত্যার দায় এড়াতে পারে না। বিবৃতিতে তারা চলমান শাটডাউন কর্মসূচি সফল করার আহ্বান জানান।