অশান্ত উত্তাল পাহাড়ি জনপদ দীঘিনালা। সেখানে রক্তপাত ঘটেছে, উদগীরণ হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। শান্ত প্রকৃতির ছায়া শীতল সৌহার্দ্যতার মাঝে বাজছে সংঘাতের দামামা, আবার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে পাহাড়ি-বাঙালি। ভালো নেই খাগড়াছড়ি, ভালো নেই সেখানকার মানুষজন।
খাগড়াছড়ির মধুপুর, মহাজনপাড়া, দিঘীনালা, বাবুছড়ার নানা জায়গায় হামলা-ভাঙচুর হয়েছে, আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বাড়িঘর, দোকানপাট, সবকিছু।
সেটেলার বাঙালি যুবক হত্যার অভিযোগকে কেন্দ্র করেই সীমাহীন অরাজকতার সূত্রপাত ঘটে, ক্রমেই তা ছড়িয়ে পড়ে পাহাড় থেকে পাহাড়ে। টানা দুদিন ধরে স্পর্শকাতর ওই জনপদে সংঘাতের বিস্তার ঘটলো কিভাবে? বাধাহীন নৈরাজ্যের পেছনে কারা দায়ী? সবকিছু খুঁজে বের করার পাশাপাশি সকল ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারে জরুরি ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নেওয়া হোক, এখনই।
বৃহস্পতিবার রাতভর পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। এ সংঘর্ষে অন্তত তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন উভয় পক্ষের ৩০ জনেরও বেশি। এসময় অসংখ্য বাড়িঘর, দোকানপাট আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নিহতরা হলেন- ধন রঞ্জন চাকমা (৫০), রুবেল ত্রিপুরা ও জুরান চাকমা (২০)। এর মধ্যে রুবেল ত্রিপুরা ও জুরান চাকমা (২০) জেলা সদরের নারানখাইয়া এলাকায় ব্রাশফায়ারে নিহত হয়েছেন। আর ধন রঞ্জন চাকমা সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
জাতিগত সংঘাত ছড়িয়ে পড়েছে দূরবর্তী রাঙামাটিতেও। সেখানেও সংঘর্ষে একজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। উত্তেজনাময় পরিবেশের জের ধরে বান্দরবানেও বিরাজ করছে থমথমে অবস্থা। সেখানে জেএসএস আর দেশীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা বুঝতে সাধারণ বাসিন্দাদের গলদঘর্ম অবস্থা। আগে সংঘাতময় পরিস্থিতি কঠোর ভাবে বন্ধ করুন, জ্বালাও পোড়াও চলবে না।
ব্যর্থতার দায়ভার গণমাধ্যমের
কয়েকটি যুগ ধরে বৃহত্তর পার্বত্য জনপদ জুড়ে অস্বাভাবিক, বিপর্যয়কর পরিবেশ চলে আসছে। এদেশেরই অবিচ্ছেদ্য অংশের বিরাট সংখ্যক পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বনাম সেটেলার বাঙালিদের মধ্যে সীমাহীন বৈরীতাসহ সঘাত সংঘর্ষ চলে আসছে। লাশের পর লাশ পড়েছে, রক্তাক্ত হয়েছে সবুজ পাহাড়। উভয়পক্ষই পরস্পরবিরোধী মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ তুলে, একপর্যায়ে সবকিছুর জন্য দায় চাপিয়ে দেওয়া হয় সেনাবাহিনীর উপর। অথচ এদেশের এতো এতো মিডিয়া, অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরও অভাব নেই। কিন্তু সুদীর্ঘ সময়েও কোনো অনুসন্ধানী সাংবাদিক টিমকে পাহাড়ে অশান্তির নেপথ্য তথ্যচিত্র তুলে ধরাসহ সহসা সমাধানের কোনো পথ বাৎলে দিতে দেখা যায়নি।
যারাই হাতি ঘোড়া নিয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে তারাই ফিরে এসে নয়তো সেটেলার বাঙালিদের পক্ষ নিয়েছে, নয়তো পাহাড়িদের ঘরের মানুষ সেজে মানবতাবাদী বনে গেছেন। কিন্তু পাহাড়ের সমস্যা অভিন্ন অবস্থাতেই জিইয়ে রয়েছে, ভিক্ষুকের দগদগে ঘা এর মতো।
বন্ধু প্রসীত ইতিহাস হও!
দীঘিনালার বিচ্ছিন্ন ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে ইউপিডিএফ নাকি অতিমাত্রায় শক্তি প্রদর্শনের নগ্ন খেলায় মেতে উঠেছে। পাহাড়ি উগ্রবাদী এ সশস্ত্র গ্রুপটির প্রধান প্রসিত খীসা আমার ২৩ বছরের পুরোনো বন্ধু। লীগ পতনের পর বিএনপির প্রভাব বৃদ্ধির সাথে সাথে বন্ধুর ইউপিডিএফ কি অলৌকিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠলো?
আপাতত রক্তের হলিখেলায় বিরতি দাও বন্ধু, নতুন দেশ গঠনে এগিয়ে আসো, সক্রিয় ভূমিকা রাখো। তাহলেই পাহাড়ি জনগোষ্ঠী তাদের স্মৃতির মণিকোঠায় শত শত বছর তোমাকে ঠাঁই দিবে।
পান থেকে চুন খসলেই সুযোগ নেয় ভারত
আমরা মণিপুরের স্বাধীনতাকামীদের সহমর্মিতা জানালে, ভারত আমাদের পার্বত্য উগ্রপন্থী গ্রুপগুলোকে লেলিয়ে দেয়। আমরা মিজোরামের অত্যাচারী, বঞ্চিত, দিশেহারা মিজোদের পক্ষে বললে ভারত তখন ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সাজিয়ে কুকিচিনকে বান্দরবানে পাঠায় ম্যাসাকার ঘটাতে।
আমরা শুধু শান্তি, শৃংখলা আর প্রতিবেশী রাষ্ট্র দানবের মঙ্গল চাই বলে উলফা, এনডিএফবি, আচিক ফ্রন্ট, বড়ো বিদ্রোহী, এনএলএফ, পিএলএ, কেএনএলএফ সহ দুই ডজনেরও বেশি উগ্রপন্থী সশস্ত্র গ্রুপকে বিন্দুমাত্র সুযোগ দেই না, সাহায্য করি না।
স্বাধীনতাকামী এসব সশস্ত্র দল – উপদলকে শুধু সীমান্তবর্তী নোম্যানস ল্যান্ডে অবস্থানের সুবিধাও যদি দেওয়া হয় তাহলে ত্রিপুরা, মিজোরাম, আসাম, মেঘালয়, অরুণাচল, মনিপুর, নাগাল্যান্ডে কিন্তু ভারতের জাকান্দানি শুরু হয়ে যাবে। বাস্তবতায় এখন আসলেই ভারতকে অস্থিরতায় ঠেলে দেওয়া ছাড়া আমাদের পাহাড়ে শান্তি বজায় রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
(লেখক সিনিয়র সাংবাদিক)
.