এতে করে একদিকে তাদের পেশা হুমকির মুখে পড়েছে; অন্যদিকে তাদের অনুপস্থিতিতে পরিবারের সদস্যরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ভুক্তভোগী এসব পরিবারের সদস্যরা সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে সাংবাদিকদের এসব হয়রানিমূলক মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
হত্যা মামলায় আসামি হওয়া চার সাংবাদিক হলেন- বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সহসভাপতি বগুড়া প্রেসক্লাবের সভাপতি ও দৈনিক জনকণ্ঠের স্টাফ রিপোর্টার মাহমুদুল আলম নয়ন, বিএফইউজের নির্বাহী সদস্য ডেইলি অবজারভারের জেলা প্রতিনিধি বীর মুক্তিযোদ্ধা এএইচএম আখতারুজ্জামান, বগুড়া সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি দৈনিক কালের কণ্ঠের বগুড়া জেলা প্রতিনিধি জেএম রউফ এবং ইনডিপেনডেন্ট টিভির উত্তরাঞ্চলীয় প্রধান হাসিবুর রহমান বিলু।
বিস্ফোরক আইনসহ বিভিন্ন ধারায় মামলার আসামি হয়েছেন ১৪ সাংবাদিক। তারা হলেন- দৈনিক কালের কণ্ঠের নন্দীগ্রাম উপজেলা প্রতিনিধি ফিরোজ কামাল ফারুক, দৈনিক কালবেলার সারিয়াকান্দি প্রতিনিধি মঞ্জু মিয়া, যায়যায়দিনের শিবগঞ্জ প্রতিনিধি সোহেল আক্তার মিঠু, দৈনিক ইত্তেফাকের আদমদীঘি প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেন, প্রতিদিনের বাংলাদেশের আদমদীঘি প্রতিনিধি জিআরএম শাহজাহান, ভোরের দর্পণের মোকামতলা প্রতিনিধি আপেল মাহমুদ, দৈনিক উত্তরের দর্পণের মোকামতলা প্রতিনিধি আবু জাফর ইকবাল, দৈনিক জয় যুগান্তরের মোকামতলা প্রতিনিধি হাসান আলী, দৈনিক চাঁদনী বাজারের আদমদীঘি প্রতিনিধি মিহির কুমার সরকার, দৈনিক চাঁদনী বাজারের সান্তাহার প্রতিনিধি মতিউর রহমান সাগর, দৈনিক ভোরের দর্পণের সোনাতলা প্রতিনিধি নিপুন আনোয়ার কাজল, দৈনিক প্রভাতের আলোর সোনাতলা প্রতিনিধি মাহমুদুর রশিদ সোহেল, দৈনিক ভোরের খবরের সোনাতলা প্রতিনিধি মোস্তাফিজার রহমান পিন্টু এবং দৈনিক করতোয়ার নন্দীগ্রাম উপজেলা প্রতিনিধি ও উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি বকুল হোসেন। এ ছাড়া বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকমের বগুড়ার স্টাফ রিপোর্টার জিয়া শাহীনের বিরুদ্ধে রাজশাহীর সাইবার ট্রাইব্যুনালে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে সেটির আদেশ এখনও দেননি আদালত।
পুলিশ ও মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ৪ আগস্ট বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শহরের ঝাউতলা এলাকা থেকে সদর থানায় হামলা করা হয়। এ সময় গুলিতে শহরের দক্ষিণ বৃন্দাবনপাড়ার দর্জি মো. শিমুল নিহত হন। ২৭ আগস্ট রাতে নিহতের স্ত্রী শিমু বেগম সদর থানায় শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের ও আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক এমপি মজিবর রহমান মজনু ও রাগেবুল আহসান রিপু, সাংবাদিক হাসিবুর রহমান বিলু, মাহমুদুল আলম নয়ন এবং জেএম রউফসহ ১৩৫ জনের নাম উল্লেখ করে ৪০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন।
একই দিন ওই স্থানে রিপন ফকির নামে এক ব্যক্তি গুলিতে নিহত হন। নিহতের স্ত্রী মাবিয়া বেগম ১৭ সেপ্টেম্বর সদর থানায় শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, ওবায়দুল কাদের, সাংবাদিক আখতারুজ্জামানসহ ১০৪ জনের নাম উল্লেখ করে ৩০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে হত্যা মামলা করেন।
সদ্যবিদায়ী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইহান ওলিউল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দুটি হত্যা মামলায় চার জন সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে। তবে এখনও কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।’
অপরদিকে, জেলার বিভিন্ন থানায় ১৪ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, নাশকতা ও বিস্ফোরক আইনের বিভিন্ন ধারায় মামলা হয়েছে। পাশাপাশি সাংবাদিক জিয়া শাহীনের বিরুদ্ধে রাজশাহীর সাইবার ট্রাইব্যুনালে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন যায়যায়দিনের জেলা প্রতিনিধি ইমরান হোসেইন লিখন।
এদিকে, ১৮ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা ও একজনের নামে সাইবার ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দেওয়ায় বগুড়ার সাংবাদিকদের মাঝে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
মামলার আসামি সাংবাদিক বকুল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তিনি নন্দীগ্রামে বসবাস করলেও বগুড়া শহরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় চোখে গুলিবিদ্ধ রানা মিয়া তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছেন। মামলার কারণে গ্রেফতার এড়াতে বাড়ি থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এতে তার পরিবারের সদস্যরা কষ্ট পাচ্ছেন। সঠিকভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হওয়ায় তার চাকরি ঝুঁকিতে পড়ে গেছে।
হত্যা মামলার আসামি দুজন সাংবাদিকের স্ত্রী-সন্তানরা জানান, থানা ও সরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় হামলার সময় পুলিশের গুলিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা নিহত হন। অথচ বিএনপি-জামায়াত নেতা এবং জনপ্রতিনিধিদের পরামর্শে করা মামলায় সাংবাদিকদের আসামি করা হয়। মামলার পর থেকে সাংবাদিকরা আত্মগোপন করায় পরিবারের সদস্যরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এতে তাদের সংসার চলছে না।
দুটি হত্যা ও অন্য দুটি মামলার তিন জন বাদী জানান, স্বজনরা হতাহত হওয়ায় তাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তবে তারা স্থানীয় বিএনপি-জামায়াত ও জনপ্রতিনিধিদের পরামর্শে মামলাগুলো করেছেন। অধিকাংশ মামলার আসামিদের তারা চেনেন না। তারা শুধু এজাহারে স্বাক্ষর দিয়েছেন। এসব নিয়ে তারাও উদ্বিগ্ন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলার দুই সাংবাদিক নেতা জানিয়েছেন, পেশাদার এসব সাংবাদিক কখনও কোনও অপরাধের সঙ্গে জড়িত নন। অথচ তাদের হত্যাসহ বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। তারা আত্মগোপন করায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। তাদের কর্মজীবন হুমকিতে পড়েছে। আর পরিবারের সদস্যরা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। দর্জি মো. শিমুল ও শ্রমিক রিপন ফকির কাদের গুলিতে নিহত হয়েছেন, তা আমাদের জানা আছে। অথচ সাংবাদিকদের ওই হত্যা মামলায় আসামি করে হয়রানি করা হচ্ছে। এসব মিথ্যা মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে সরকারের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করছি আমরা।
বগুড়ার পুলিশ সুপার মো. জেদান আল মুসা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মামলাগুলো তদন্ত করে আসামিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে নিরাপরাধ কোনও সাংবাদিক যাতে হয়রানির শিকার না হন, সেদিকে খেয়াল রাখবে পুলিশ। তবে এখনও এসব মামলার তদন্তকাজ শুরু হয়নি।’
.