ঘুষ-দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্য, নারী লিজুতাসহ নানা অপকর্মে জড়িত মাগুরা জেলা অফিসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হরসিত কুমার শিকদার। তার কসরতের পিছনে ছিলেন মাগুরা জেলার সাবেক ডিসি আশরাফুল আলম ও আবু নাসের বেগ। তাদের সহকারী হওয়ায় এবং সখ্যতা থাকায় অবৈধভাবে অর্জিত সমস্ত অর্থ নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে একের পর এক অপকর্ম করেছেন নির্দ্ধিদায়। কেউ তার টিকিটিও ছুঁতে পারেননি।
মাগুরা ডিসি অফিস সূত্রে জানা যায়, হরসিত কুমার শিকদার দীর্ঘদিন থেকে মাগুরার কালেক্টরে চাকুরি করায় প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে রয়েছে তার হাত। ঘুষ-দুর্নীতি থেকে শুরু করে নিয়োগ বাণিজ্য, নারী লিন্দুতাসহ নানা অপকর্মসহ কোনো কাজই বাদ যায়নি তার হাত থেকে। তার নাটের গুরু ছিলেন সাবেক ডিসি আশরাফুল আলম ও আবু নাসের বেগ। তাদের ঈশারা ইংগিতে এসমস্ত কাজ করে টাকা-পয়সা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিতেন তিনি।
তিনি নাজির থাকাকালে বিগত ২০১৪ সাল থেকে শুরু করে গত ৯-১০ বছরে যত নিয়োগ বাণিজ্য হয়েছে তার প্রতিটি ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন হরসিত কুমার শিকদার। মাগুরা জেলার ডিসিরা নিয়োগ প্রক্রিয়ার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকায় সুযোগ হাতছাড়া করতেন না তিনি। বিশেষ করে ডিসি অফিসে এম এল এসএস, ইউনিয়নের সচিব, হিসাব সহকারী, পরিবার পরিকল্পনা দপ্তরের ‘স্বাস্থ্য সহকারী’, শিক্ষা অফিসের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ, জেলা পরিষদের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেয়ার সময় তার জন্য বরাদ্দ রাখা হতো নির্ধারিত কোটা। তার বরাদ্দকৃত কোটাকে বলা হতো হরসিত কোটা। যা সকল নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিলো। এর প্রতিটি পদের বিপরীতে নেয়া হতো ১২-১৫ লক্ষ টাকা। এ সমস্ত টাকা নাজির হরসিত কুমার শিকদার (বর্তমানে প্রশাসনিক কর্মকর্তা) নিয়োগ দেয়ার আগে তার লোকজনের মাধ্যমে সংগ্রহ করে ডিসি সাহেবদের সাথে বসে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিতেন। সর্বশেষ ডিসি অফিসে যে ছয়জন সচিব নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তার মধ্যে ০৫ জনই টাকার বিনিময়ে তার মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর আগে টাকার বিনিময়ে আরও ২০ জন হিসাব সহকারী পদে লোক নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তার মধ্যে ১৫ জনই হচ্ছেন হরসিত কুমারের। আর এর পিছনে রয়েছে আরেক রহস্য, তা হলো- হরসিত কুমার শিকদার সাবেক ডিসি আশরাফুল আলম ও আবু নাসের বেগকে সুন্দর সুন্দর নারী সাপ্লাই দিয়ে মনোরঞ্জনে সহযোগিতা করতেন। যার কারণে কোনো কাজে বেগ পেতে হয়নি তার।
২০২২ সালে পরিবার পরিকল্পনা দপ্তরের ‘স্বাস্থ্য সহকারী’ পদে ২৫ জনের নিকট হতে নেয়া হয়েছে ১০-১২ লক্ষ টাকা করে। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন সাবেক ডিসি আশরাফুল আলম ও হরসিত নাজির। হরসিত কুমার নিজের এসুযোগকে কাজে লাগিয়ে পরিবারের সকল সদস্যদের চাকরী দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, হরসিত বাবু তার নিজের ছোট ভাইকে প্রতিবন্ধি সাজিয়ে ডি সি অফিসে চাকরি দিয়েছেন। এছাড়াও তার ভাইয়ের ছেলে এবং প্রতিবেশীসহ অনেককে তদবীর করে চাকরি দিয়েছেন। নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্জন করা টাকার ভাগাভাগির বিষয়টি ডিসি সাহেবের ড্রাইভার সনজয় বাবু জানায় ডিসি সাহেব নাজির হরসিতকে চাপ দিয়ে মাত্র ৫ লক্ষ টাকার বিনিময়ে ড্রাইভারের মেয়েকে হিসাব সহকারী পদে চাকরী দিতে বাধ্য করেন। এখানে শেষ নয়, তার কারণেই বেআইনীভাবে সিনিয়র কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে জুনিয়রদের পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে। যা নথিপত্র অনুসন্ধান করলে পাওয়া যাবে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, সহায় সম্বলহীন পিতা হরেন্দ্রনাথ শিকদারের নামে একমাত্র বাড়ি ছাড়া অন্যকোনো সম্পদ ছিল না। কিন্তু আজ সেখানে তার ছেলে হরসিত শিকদারের নামেই রয়েছে প্রায় ১৮ একর জমি। বাবা হরেন বাবুর নামে ক্রয় করেছেন প্রায় ১৩ একর সম্পত্তি। যার প্রতি শতক জমির বাজার মূল্য ১ লক্ষ ২০ হাজার হতে ১ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা। মাগুরা মৌজায় ১৪১৬ দাগে ২০ শতক এবং ১৪১৭ দাগে ৭ শতক জমি রয়েছে তার। যার বাজার মূল্য প্রায় ১ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা। আরও স্ত্রী নন্দীতা বিশ্বাসের নামে ৯৫৩০, ১৪১৬, ১৪১৭ নং দাগে হরসিত কুমার শিকদারের নিজ নামে ৫৬৩, ৪১২, ৪১৩, ৪১৪ নং দাগে ও স্ত্রী নন্দীতা বিশ্বাসের নামে ৫৮৭, ৪৮৪, ৫৯৫, ৪১১, ৭০৬, ১০১৩, ১০১৪, ১০১৮, ২৩৫, ২৪২, ২৫২, ৪ নং দাগে, হরসিত কুমার শিকদারের নামে ৪৯,৪৭০,৫৪৩,৬০৬, ৫৬৪ নং দাগে এবং পিতা হরেন্দ্রনাথ শিকদারের নামে ৫৬৬, ৫৭৩ নং দাগে প্রচুর সম্পত্তি রয়েছে।
এছাড়াও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে-তার বাবার মৃত্যুর দুইদিন আগে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে কমিশন করে সাব- রেজিস্ট্রারকে বাড়িতে নিয়ে বাবার নামে রাখা সমস্ত সম্পত্তি রাতারাতি নিজ নামে ও তার স্ত্রী নন্দীতার নামে লিখে নেন। এসব সম্পত্তির আনুমানিক মূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা। তাছাড়াও ভাই-বোন, পরিবারের সদস্য ও আত্মীয় স্বজনের নামে কোটি কোটি টাকার রয়েছে বিপুল পরিমাণ সম্পদ, যা তদন্ত করলে বা অনলাইন তল্লাশি করলেও এর সত্যতা পাওয়া যাবে।
স্থানীয় সূত্রে আরও জানা যায়, মাগুরা জেলায় রয়েছে প্রায় ১২২টি ইট ভাটা। পরিবেশ দূষণের নাম করে এসব ইটভাটা থেকে প্রতি সিজনে প্রকারভেদে ৫-৮ নদ টাকা হারে চাঁদা নিতেন হাসিত কুমার। যা সাবেক ডিসি আরশাফুল ও আবু নাসের বেগ মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে দিতেন। বর্তমানে তা তিনি একাই ভোগ করছেন। এছাড়াও হরসিত কুমার শিকদারের আরও রয়েছে বিভিন্ন সমিতি। রয়েছে জুয়েলারী সমিতি, কারিগর সমিতি, এসিড লাইসেন্স সমিতি, কাঁচা বাজার সমিতি, লোহা বাবসায়ী সমিতি, ওষুধ ব্যবসায়ী সমিতির খাত থেকেও পান প্রচুর পরিমাণ টাকা।
বিল প্রদান ও পদোন্নতি প্রদান করে প্রতিমাসে প্রসেস সারভারদের বিল হতে ২০% কমিশন নিতেন তিনি। এ নিয়ে সকলের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। প্রসেস সারভারের অনেকে বলেন, আমরা এত কষ্ট করি, রোদ-বৃষ্টি-ঝড় মাথা নিয়ে ডাক টানি। অথচ সেই বিল হতে তাকে কেন ২০% টাকা দিতে হবে। এ কথা শুনে নাজির বিল দেয়া বন্ধ করে দেয়। পরবর্তীতে আবার প্রসেস সারভারদের অনুরোধে একই ব্যবস্থা চালু করা হয়। এছাড়া জুলাই মাসে হরসিত ভূয়া ভাউচারের মাধ্যমে অনেক টাকা তুলে আত্মসাত করেছেন। আর এ কাজে তাকে সাহায্য করে অফিসের পিয়ন সাজাহান এবং অবসরপ্রাপ্ত দুর্নীতিবাজ কর্মচারী সুজাউদ্দৌলা। এই সুজাউদ্দৌলা এতই দুর্নীতিবাজ ছিলেন যে, তিনি ৫ বার সাসপেন্ড হয়েছেন। সর্বশেষ চাকরীতে পদোন্নতি না পেয়ে সাবেক ডিসি শফিউল আলমের