রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। মৈনটঘাটে দাঁড়িয়ে আছি রিকশার জন্য। সাথে লেজুড়বৃত্তিহীন সাংবাদিক মিলন মেলার যুগ্মআহবায়ক দেশ পত্র পত্রিকার সম্পাদক নাছিরউদ্দিন পল্লব ভাই ও তাঁর সাথে আরেকজন ছোট ভাই যার নামটা আমার জানা নেই। ১৮ তারিখ সারাদেশের ৬৪ জেলা থেকে আগত ২১৭ জন পেশাদার সাংবাদিক সহকর্মীদের সাথে মতবিনিময়, আনন্দ, আড্ডা শেষে রাতে ঘুমাতে যাব প্রায় ১২ কিমি দূরে। আমি আর আমার সাথে কুমিল্লা লাকসামের কালের কন্ঠর প্রতিনিধি সৈয়দ মুজিবুর রহমান দুলাল। দুলাল ভাই চমৎকার ভালো মনের মানুষ। সাধক পুরুষ। সাইজির গান দরদি কন্ঠে ভেসে আসলে চমৎকৃত হয়ে না তাকিয়ে, মনোযোগ সহকারে গান না শুনে থাকা মুশকিল। মিলন মেলার প্রধান আকর্ষন সাইদুর রহমান রিমন ভাই সাংবাদিকদের জন্য এসি রোমের সুব্যবস্থা করেছেন। নবীনগরের কথার সম্পাদক শিল্প সাহিত্যমনা সদা হাস্যোজ্জল গৌরাঙ্গ দেবনাথ অপুদাই পল্লব ভাইয়ের হাতে আমাদের তুলে দেন এসিরোমে নিয়ে যাওয়ার জন্য। মিলন মেলা চত্বরে পদ্মানদীর পাড়ে থাকা খাওয়ার বিশাল আয়োজন রেখে চলে যাচ্ছি বারো কিমি দূরে।
পল্লব ভাই কয়েকটি অটোরিকশা থামালেন। সবারই ব্যস্থতা, কেউ আবার রিজার্ভ যাত্রী নিয়ে এসেছে। একটি অটোরিকশা আসার পর পল্লব ভাই তাকে আমাদের ঘুমানোর জায়গায় পৌছে দিতে বললেন। কাঁধে গামছা, পড়নে লুঙ্গি সার্ট পড়া চালক জানালেন তাঁর রিকশায় চার্জ নেই এতদূর যেতে পারবে না। বড়জোর কার্তিকপুর বাজার পর্যন্ত যেতে পারবো। রিকশার জন্য অপেক্ষা করছি। রাতপ্রায় বারোটা। আমাদের গতিবিধি ও কথাশুনে লোকটি বললো আপনারা কি রাতে ঘুমানোর জন্য যাবেন। বললাম হ্যা। স্যার যদি কিছু মনে না করেন এই গরিবের বাড়িতে আসলে খুশি হতাম। আমার সাতাশের বন্দের টিনের ঘর আছে। তার কথা শুনে সাধক পুরুষ দুলাল ভাই কোন চিন্তা ভাবনা না করেই বলল গাজী ভাই আসেন আজ রাতে তাঁর বাড়িতেই থাকব। পল্লব ভাই বললো আপনারা যান আমি হোন্ডা নিয়ে আসছি।
আমরা বাড়িতে পৌঁছাতেই পল্লব ভাই হাজির। ফকির বাড়ি বছরে দুইটা ওরশ হয়। দূর থেকে গিয়েছি তাই পল্লব ভাই অত্যন্ত সচেতনভাবে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করে চলে গেলো। যেতে যেতে যা জানতে পারলাম আমরা রিকশাচালক মজিবর রহমান ফকিরের কথায় যারপর নাই অভিভূত। এমন বড় মনের মানুষও আছে দুনিয়াতে। মৈনটঘাট দিয়ে যারা লঞ্চে ফরিদপুর সহ অন্যান্য এলাকায় যায় তারা যদি রাতে লঞ্চ বা স্পীড বোর্ড না পায় তাহলে মজিবর ফকির নিজের রিকশা করে বিনা ভাড়ায় তাঁর বাড়িতে রাত্রী যাপনের ব্যবস্থা করেন।
বাড়িতে গিয়ে আরো অবাক হলাম। মজিবর ফকির ও তার তিন ছেলে থাকেন একটি ঝুপড়ী ঘরে অথচ অপরিচিত মেহমানদের জন্য বিশাল আয়োজন। রাতে খাবারের জন্য অনেকবার বললেন। তাঁর স্ত্রী আমাদের জন্য চৌকির চাদর নিয়ে আসলেন। চাঁদর আমি নিয়ে যাওয়ায় আমারটাই বিছালাম। টিউবওয়েল থেকে পানি, নামাজের জন্য খেজুর পাতার জায়নামাজ রেখে গেলেন। মানুষের মন এত বড় কিভাবে হয় তা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ফজর নামাজ শেষে আবারো ঘুম। সকালে উঠে দেখি আমাদের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করেছে তাঁর সাধ্যমতো। যেহেতু মিলন মেলায় খাবারের আয়োজন তাই খেতে পারলাম না। চলে আসার আগে তাঁর ছোট ছেলে বয়স ১২/১৪ হবে তাঁকে আমাদের সাথে খাবারের আমন্ত্রণ জানিয়ে আসলাম। মজিবর রহমা ফকির আমাদের মৈনটঘাটে রিকশা করে নামিয়ে দিয়ে গেল তাঁকেও বার বার অনুরোধ করলাম দুপুরে যেন খেয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত তিনি না আসলেও তাঁর ছেলে আসায় আমরা খুবই তৃপ্তিভরে খেতে পারলাম।
মজিবর ফকিরের কথা ভাবলে মানুষের জন্য কিছু করার উৎসাহ আরো বেড়ে যায়। একজন রিকশাচালকের মন এত বড় হয় কিভাবে? ভালো থাকুক মজিবর ফকিরের মতো বড় মনের মানুষেরা এই কামনা করি।
‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’ মজিবর রহমান এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এরাই তো মানবতার প্রকৃত ফেরিওয়ালা।
*গাজী মোবারক ভাইয়ের ফেসবুক পোস্ট থেকে