‘শেষ ভালো যার- সব ভালো তার’ আমরা মাধ্যমিকের গণ্ডিতে বাংলা ব্যাকরণ পাঠদানকারী পণ্ডিত স্যারের মুখে এমন একটি শ্লোক শুনতে শুনতেই বেড়ে উঠেছি। গাজীপুরের জয়দেবপুরে নির্মম হামলা ও হয়রানির শিকার সাংবাদিক আমিনুল ইসলামের বিষয়টি মাত্র ১৪ ঘণ্টার মধ্যেই সম্মানজনক সুরাহা হওয়ায় আবার যেন শেষ ভালো‘র স্বাদ পেলাম। বাস্তবে গাজীপুর সদর উপজেলা প্রেসক্লাবের সকল কর্মকর্তা ও সদস্যদের অটুট ঐক্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধা-ভালোবাসা এবং জয়দেবপুর থানার অফিসার্স ইনচার্জ আব্দুল হালিম এর ভুল স্বীকার করার মতো নমনীয় মনোভাব ও ব্যক্তি আচরণের বনেদি সভ্যতা উদ্ভূত জটিল-কঠিন অবস্থার দ্রুতই অবসান ঘটিয়েছে।
ঘটনার মূল সূত্রপাত ২১ জানুয়ারি দুপুরে ঘটলেও তার উল্লেখযোগ্য বিস্তৃতি ও সমন্বিত বাদপ্রতিবাদ গড়ে উঠে গতকাল- শুক্রবার। এদিন সকাল সাড়ে ৯ টায় ফেসবুকের টাইম লাইনে সাংবাদিক আমিনুলের উপর হামলা, মামলা, হয়রানি, নিপীড়নের দুর্ভাগ্য চিত্র তুলে ধরা হয়। কয়েক মুহূর্তেই তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, আমিনুলের কষ্টগাঁথা সর্বত্রই সাংবাদিকদের হৃদয়ে ক্ষতচিহ্নের রূপ নেয়। ফুঁসে ওঠেন সবাই, শুরু হয় বাদপ্রতিবাদ, প্রকাশ ঘটতে থাকে ক্ষোভ-ঘৃণার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ওয়ালে ওয়ালে কঠোর প্রতিবাদ, তীব্র নিন্দার ঝড় বইতে থাকে, ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে অনেকে গালাগাল দিতেও দ্বিধা করেননি।
আমিনুল ইসলামের ঘটনায় গাজীপুর সদর উপজেলা প্রেসক্লাবের উদ্যোগে শনিবারের মানববন্ধন কর্মসূচির বিষয়টি তুলে ধরতেই সাংবাদিকদের অন্যরকম সহমর্মিতা দেখতে পাই। দুপুরে জুম‘আ নামাজ শুরুর আগেই ২০/২২টি উপজেলা থেকে উৎসাহী সাড়া মেলে। কষ্টকান্নার বিবরণ প্রকাশের সূত্র ধরে অনেকেই আমার ইনবক্সে ম্যাসেজ পাঠান, কল দিতে থাকেন ম্যাসেঞ্জারে। সোনারগাঁওয়ের সাংবাদিক নেতা গাজী মোবারক, নরসিংদীর আল-আমীন মুন্সী, ঢাকা দোহারের নাসিরউদ্দিন পল্লব, সাভারের পারভেজ মুন্না, কেরানীগঞ্জ থেকে রতন সরকার, বিডিসি বার্তার ফয়সাল হাওলাদার, আশুলিয়া রিপোর্টার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক নূর আলম সিদ্দিকী মানু, ময়মনসিংহের মাঈনউদ্দিন উজ্জ্বলসহ কয়েকজন দফায় দফায় ফোন করে মানববন্ধনে অংশগ্রহণের অভিপ্রায় জানান। কুমিল্লা থেকে সংবাদ টিভির চেয়ারম্যান জুয়েল খন্দকার ধারাবাহিক সাংবাদিক নির্যাতনের প্রতিবাদে নিজের ক্ষুব্ধ অভিব্যক্তি তুলে ধরেন। তিনি জানান, কুমিল্লা থেকে অন্তত দশ জন সাংবাদিক নিয়ে হোতাপাড়ার মানববন্ধনে হাজির থাকবেন।
পারস্পরিক বিরোধ, মতভিন্নতা দূরে ঠেলে নিজ উদ্যোগেই ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ জানানো নিয়ে সাংবাদিকদের এমন স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহ আমি আগে দেখিনি। সম্ভবত হামলা, মামলা, টিভি চ্যানেল-পত্রিকা জবর-দখলসহ ঐতিহ্যের সাংবাদিকতাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের অভাবনীয় বিপন্নতায় সিংহভাগ গণমাধ্যমকর্মী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছেন। অস্তিত্বহীনতার আচমকা থাবায় বোধহারাগণও যেন সম্বিত ফিরে পাচ্ছেন। দেখছেন, গণমাধ্যমের অস্তিত্বই নিঃশেষ হতে চলেছে। যেখানে সাংবাদিকতা টিকিয়ে রাখাটাই অনিশ্চিত- সেখানে সাংবাদিকদের নিয়ে আলাদা কিছু ভাবাভাবির সুযোগ কোথায়? বোধকরি সংখ্যালঘু, পিছিয়ে পড়া জনপদ ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর আদলে গণমাধ্যম কর্মীদেরও স্বতঃস্ফূর্ত ঐক্য গড়ে ওঠার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে হয়ত।
যাহোক, হোতাপাড়ায় অনুষ্ঠিতব্য মানববন্ধনে কয়েকশ সাংবাদিকের অংশগ্রহণ বিক্ষুব্ধ প্রতিবাদে পরিণত হওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়। সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তাদের পরামর্শে তৎপর হয়ে ওঠেন ওসি আব্দুল হালিম। স্থানীয় সর্বজন শ্রদ্ধেয় সিনিয়র সিটিজেন, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সমাজ সংগঠকসহ সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনার মাধ্যমে বিরোধপূর্ণ পরিস্থিতির অবসানে নিরন্তর ছোটাছুটি চলে তার। সকল মহলের অনুরোধে শুক্রবার রাত আট টায় গাজীপুর সদর উপজেলা প্রেসক্লাব জরুরি বৈঠকে বসে। প্রেসক্লাব সভাপতি আবুল কাশেম এর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিনের সঞ্চালনায় সকল সাংবাদিকের উপস্থিতিতে পাঁচটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
এগুলো হচ্ছে, সাংবাদিক আমিনুল ইসলামের উপর নৃশংস হামলাকারীদের বিরুদ্ধে সর্বনিম্ন সময়ের মধ্যে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়া, তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রত্যাহার, হয়রানির অসৎ উদ্দেশে মনগড়া মামলা সাজানোর প্ররোচনাকারী দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে অবিলম্বে হটিয়ে নেওয়া। পাশাপাশি মোটা অর্থের বিনিময়ে ভাড়াটে শ্রমিকদের দ্বারা কথিত মানববন্ধনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারসহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী চক্রের বিরুদ্ধে পুলিশের উদ্যোগে দৃষ্টান্তমূলক আইনি ব্যবস্থা গ্রহণেও একমত পোষণ করা হয়। রাতেই জয়দেবপুর থানার অফিসার্স ইনচার্জসহ দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা প্রেসক্লাব কার্যালয়ে যান এবং সৃষ্ট অপ্রীতিকর পরিস্থিতির জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে দুঃখ প্রকাশ করেন। এদিকে প্রস্তাবনা তুলতেই তা বাস্তবায়ন শুরু হওয়ায় পূর্ব ঘোষিত মানববন্ধনটি স্থগিতের ঘোষনা দিয়েছেন প্রেসক্লাব নেতৃবৃন্দ।
গাজীপুরের জনপদে সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির ঘটনায় সারাদেশ থেকে যে-সব সাংবাদিক বন্ধু ও পেশাজীবী সংগঠন বাদ প্রতিবাদ করেছেন, সহমর্মিতা জানিয়েছেন- তাদের সকলের প্রতি গাজীপুর সদর উপজেলা প্রেসক্লাব নেতৃবৃন্দ গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। অধিকার বঞ্চিত সাংবাদিকদের সার্বজনীন ঐক্য হলেই সাংবাদিক নির্যাতন রোধ করা যায়, নিশ্চিত হয় সুরক্ষা- জয়দেবপুরের সফলতায় আবারও তা প্রমাণিত।